১,২,৩…২০ । একজন, দুজন নয় – ২০ জন তরতাজা প্রাণ চলে গেলো আমাদের। ও পক্ষে কত গেলো? যান, গুগল করুন।
এর ফাঁকে একটু গৌরচন্দ্রিকা। কিছু দিন আগে মন হাতির মত বড় হয়ে গেছিলো। মাঝে বিষাদে (সু)শান্ত ছিল। এখন চিন চিন করছে। আর আজকাল কি একটা ব্যারাম হয়েছে, সব ব্যাপারে রিয়াক্ট করা চাই। কি করব বলুন, চায়ের টেবিলে গ্যাজানোটা ‘আর নেই’। হোয়াটসআপেও জন্মদিন ছাড়া কেউ পাত্তা দেয় না। অতএব, যত অ্যা, ফেসবুক ওয়ালে।
যাক গে, গুগল করে কি পেলেন? ওদের ২০ এর থেকে বেশি? ‘ইউরেকা ইউরেকা, আমরা জিতেছি, আমরা জিতেছি’ বলতে বলতে মার কাছে চলে যান, যান।
নাকি, ২০ এর থেকে কম? তবে কি আমরা হেরে গেলাম? না না, সে কি করে হয়? চলুন, গর্জে উঠি। এর একটা প্রতিকার চাই চাই।
কি মশাই, কনফিউজড হয়ে গেলেন নাকি? এ মাল চীনে চালান করবেন নাকি সিয়াচেনে পাঠাবেন বুঝতে পারছেন না? তার আগে আসুন, যেহেতু ওপক্ষে কতজন মারা গেল, সে হিসেব কেউ দিচ্ছে না, সব্বাই কুলুপ এঁটে বসে আছেন,হার জিতের হিসাবটা একটু সহজ করে বুঝে নিই।
দুদিন আগেও ২০ জন যুবক এই পৃথিবীতে শ্বাস নিত। আজ তারা নেই, আমরা তাহলে হেরে গেলাম না? ও পক্ষেও হয়তো X জন আর নেই। ওরাও তো তাহলে হেরেছে। দু পক্ষই তো তাহলে হারল।
যাচ্চলে! আপনি কি ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ বলে সাদা পায়রা ওড়াতে এলেন নাকি?
না মশাই, জানি, চেয়ারে বসে বসে ফেসবুকে এসব টাইপ করা ভারী সোজা। তাছাড়া, গদিতে যারা বসে আছেন, তারা যীশু বা বুদ্ধ নন, war monger যদি নাও বা হন, নিদেনপক্ষে ধুরন্ধর রাজনিতিবিদ তো বটেই। বাস্তবটা যখন এটাই, যে গদি ওয়ালারা গদিতে বসে বসে চাল ভাবছেন আর ক’টা বোরে এগোনো যাবে, যাতে আখেরটা ঠিক থাকে, সেখানে বসে ‘শান্তি শান্তি’ কথা বলে বিশেষ কাজ নেই। তার চেয়ে হার জিতের হিসাবটা আরও প্র্যাক্টিকালি করা যাক।
আমাদের ২০ জন মারা গেলো। ওদের X জন। আপাতত নাকি আলাপ আলোচনা করে দু পক্ষেই সেনা সরিয়ে নিয়েছে গোলমালের জায়গা থেকে। কিন্তু ৭০ বছর ধরে চলা বিবাদে কিছু সুরাহা হল কি? কার বাউন্ডারী কত খানি, সে নিয়ে তো মীমাংসা কিছুই হল না। আজ থেমে থাকলেও কাল তো আবার চলবে ঘুষোঘুষি, সীমান্তে। আর তজ্জন্যে দেশের ভেতরে, অনেকটা ভেতরে, অনেক মানুষ যে গরীব রয়ে গেলো, সেটাতে সময় দেওয়া সম্ভবপর হবে না। দু দেশেই। তাহলে কেউই তো জিতল না মশাই? সেখানে এই নাম্বার নিয়ে খেলে ক্ষতি বই লাভ তো কিছু নেই! হিসাবটা তো সোজাই।
নাম্বার কথাটা যখন এসেই পড়লো, এবার আরেট্টু গভীর কথা বলে ফেলা যাক। সাধারণত এইরকম যুদ্ধ টুদ্ধ যখন হয়, নেতারা হেব্বি গরম গরম কথা বলেন। আমাদের একটা বিমান ভেঙ্গেছে, ওদের ১০ টা। আমাদের ৪ জন মারা গেছেন, ওদের ৪০। যেন সব কিছুই নিছক নাম্বার গেম। এমন ভাবখানা দেখান, যেন দারুণ সাবড়ে দিয়ে এসেছে অন্য পক্ষকে। তাতে পাবলিকের রক্ত গরম হয়। পরবর্তী পদক্ষেপ justify করা যায়। অন্য সমস্যা থেকেও মুখ সরিয়ে রাখা যায়।
কিন্তু মুশকিল হল, এটা একাত্তর সাল নয়। এখনের কূটনীতি আরও জটিল। সবাই কম বেশি বুঝে গেছে, যুদ্ধে সমস্যার সমাধান হয় না। উল্টে বাড়ে। সেটা থেকে একটা নিরাপদ এস্কেপ রুট খুঁজে নেওয়া খুব জরুরী। কিন্তু মাঝখান থেকে পাবলিকের রক্ত গরম হয়ে গেলে সেই রুট খুঁজে নেওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে।
এই যেমন ডোকলামে যেটা হয়েছিল। মাসাধিক কাল ধরে সেনা বহাল। দুপক্ষেই বুঝতে পারছে, ঢের হয়েছে, এবার ফেরা চাই। এদিকে লোকের তো দেশভক্তি টগবগিয়ে ফুটছে। তাদের জন্যে কিছু তো একটা ট্রফি নিয়ে ফেরা চাই। আর দু পক্ষেরই মুখ রক্ষা হয় এমন ট্রফি খুঁজতেই অনেক জটিলতা।
সেই প্রেক্ষাপটে এবারে ব্যাপারটা অনেক অন্য রকম লাগছে। চীনের মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসেও দেখলাম না, খুব বেশি হাউ মাউ করছে। এ পক্ষের নেতারাও অনেকটা সংযত। মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করেই তারা সব তথ্য প্রকাশ করছে না, যাতে লোকে খেপে না যায়। আর পাবলিক প্রেশারে এই পরিস্থিতিতে সত্যিই ভয়ঙ্কর যুদ্ধ না শুরু করতে হয়।
তবে সত্যিই নেতারা রাতারাতি পরিণত হয়ে গেলেন, নাকি এর পেছনে আসলে অন্য গল্প – ধরতি পারবেন না? সেটা সময়েই বলবে। সবে শুরু।
আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন ঝেড়ে কাশতে – না মশাই, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই, সত্যিই শান্তি চাই। ২০ জনের ‘প্রতিশোধ’ নিতে গিয়ে আরও একটা প্রাণ গেলেও আরও একটু বেশিই হেরে যাব।