সুইসাইড – গ্লাসটা আদ্ধেক ভর্তি, না খালি?

 ভাবুন, অঙ্ক পরীক্ষায় বসে বসে দরদর করে ঘামেন না। ন্যাশনাল লেভেলে অলিম্পিয়াড জিতে বসে আছেন। কিংবা, ১১ টা ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা ক্র্যাক করে ফেলেছেন। ভাবছেন কোন কলেজে পড়বেন। অথবা ধরুন, আপনি একটু মুচকি হেসে দিলেন- অমনি একশ জন হাজির হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে।

আপনার ব্যাপারটা জানি না মশাই। তবে আমাকে যদি এর একটাও কেউ অফার করে, আমি বর্তে যাব। মাইরি বলছি। সারা জীবনের জন্যে।

 হেব্বি নাচতে পারেন। পেটানো চেহারা। দারুণ অভিনয়। দশটার বেশি মুভি পকেটে। দারুণ সুন্দরী গার্ল ফ্রেন্ড। হাজার হাজার রমণী রোজ স্বপ্নে দেখেন। একটা টুইট করে দিলে নির্ঘাত একশ জন বাড়ির দরজায় এসে ধর্না দেবে বিয়ে করবে বলে। এইসব গুলো তো ছেড়েই দিলাম।

বড্ড হ্যাজাচ্ছি। এই বেলা একটু সিরিয়াস হওয়া যাক। তারকা অভিনেতা সুশান্ত রাজপুত সুইসাইড করেছেন। অ্যাদ্দিনে প্রসঙ্গটা পুরানো হয়ে গেছে। অনেকে সমবেদনা জানিয়েছেন। আসলে যে কারোর হঠাত চলে যাওয়াই বড় বেদনার। তবে স্টাররা গেলে লোকে গ্যাঁজায় বেশি। কিন্তু সে নিয়ে আমি যদি হিংসে করি, আর যাই হোক, মনটা যে আমার খানিক মাপে ছোট, আপনি বুঝতেই পারবেন। তবে আর কিছু দিন পরেই সবাই সব ভুলে যাবে। এবং সেটা খুব স্বাভাবিক। এই যেমন আমি নিজেই চিন ভারত যুদ্ধ টুদ্ধ নিয়ে কি একটা গুরু গম্ভীর লিখব ভাবছিলাম। বুঝতেই পারছেন, যখন যেটা টপিক, লোকে যা খায়, মানে মিডিয়া যা খাওয়ায়, তাই খেয়েই তো বেঁচে আছি।

কিন্তু তার আগে একটা জরুরী কথা। লোকে হঠাত হেব্বি সিরিয়াস হয়ে গেছেন nepotism মানে স্বজনপোষণ নিয়ে। কষিয়ে গাল মারছে কর্ণ জোহর কে। কথাটা ভারী খাঁটি। ‘এ ম্যা গো, ট্যালেন্ট নেই, তাও কেমন স্টার কিড বলে গছিয়ে দিচ্ছে, ছ্যাঃ” – এগুলো বলা খুব দরকার। সব সময়ে দরকার। তবে দুটো ‘কিন্তু’ আছে। এবং এই রকম পোস্ট লাইক বা শেয়ার করার আগে সে দুটো নিজের কাছে ক্লিয়ার করে নেওয়া খানিক দরকার মনে হয়।

প্রথমটা হল, এই সব nepotism, ধার দেনা, ছবি ফ্লপ, গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে সম্পর্কে তলানি, – ডিপ্রেশনের নানা কারণ খুঁজতে গিয়ে আপনি কি আপনার একটা বদভ্যেস হালকা করে প্রকাশ করে ফেললেন? নিজের অজান্তেই কোথাও কি justify করে বসলেন আত্মহত্যাকে? লোকটার কিন্তু বেঁচে থাকারও হাজার একটা কারণ ছিল। প্রথমেই যে একটা লম্বা লিস্ট ধরালাম – যার একটা হলেও আমি আপনি হয়তো গুপি গাইন কিংবা বাঘা বাইনের মত বরপ্রাপ্ত ভেবে বসতাম নিজেকে। একই জায়গায় থেকে আপনি বলতেই পারেন, গ্লাসটা আদ্ধেক খালি, আবার এটাও বলতে পারেন আদ্ধেক ভর্তি। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই খুব ইম্পরট্যান্ট। এটাই ঠিক করে দেবে, আপনিও, আজ না হোক কাল, ডিপ্রেসড হয়ে পড়বেন কিনা।

Is the glass half filled, or half empty?
Is the glass half filled, or half empty?

আপনি সুস্থ মানুষ হলে অবশ্যই এই বেলা একটা হাঁক পাড়বেন, মশাই, তুমি কে হে বাপু? সাত সকালে এক রাশ জ্ঞান নিয়ে হাজির হয়েছ। পুরানো আধ গ্লাস জল নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি মারাতে এসেছ? সাইকলজিস্ট নাকি হে? অভাব অনটন, কার জীবনে কি দুঃখ আছে, তুমি কতটুকু জানো বাপধন?

আপনি এরকম করে বললে আমি সত্যিই খুব অ্যাপ্রেসিয়েট করব। এখানেই আমার হালকা করে দ্বিতীয় পয়েন্ট। তার আগে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ- দুদিন আগেও আমি psychology -র বানানটা ঠিক করে জানতাম না 1, ডিগ্রীর ব্যাপারটা ছেড়েই দিন। আর খুব সম্ভবত এই লেখাটা পোস্ট করার ৫ মিনিট পরেই আপনি লাইক মারছেন না দেখে নিজেই হেব্বি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ব।

ব্যাপারটা হল, সব কিছু মোটেই সোজা সাপটা না। একটা প্রশ্ন। ধরুন, আপনি একজন তারকার বাচ্চা সন্তান। তো আপনার সামনে গালিচা বিছানো রাস্তা। লোকে যেখানে লম্বা সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে পেরিয়ে পৌঁছায়, আপনি দুমদাম এক দৌড়ে চলে যাবেন সেই খানটায়। কিন্তু আপনারও কি সম্ভাবনা নেই হোঁচট খাবার। এবং তারপরে যখন বাকি লোকেরা এবং আমার মত পাবলিক আপনাকে খিস্তি করবে, “এ বাবা, অমন একটা লোকের ব্যাটা হয়েও দেখ কেমন গড়াচ্ছে।” তখন কথা দিতে পারবেন আপনিও এমন একটা ভুল পথ বেছে নেবেন না?

আরও সোজা একটা প্রশ্ন। এই যে আমার খাঁদা নাক নিয়ে ভারী দুঃখ। কিন্তু তাও দিব্য আছি 2। কিন্তু কাল যদি রনবীর কাপুরের ছেলেরও অমন একটা নাক হয়? একই নাক নিয়ে দুটো লোকের অবসাদ কি একই রকম?

দেশে দারিদ্র না থাকলে এই যে প্রায় ১৫ হাজার চাষি প্রতি বছর আত্মহত্যা করছেন, ধরে নিলুম, তারা হয়তো সেটা করতেন না। কিন্তু চাষি ছাড়াও আরও যে ৯০% লোক সুইসাইড করলেন, তার কি হিসাব? 3 কিংবা ধরুন আমেরিকার মত একটা বড় লোক দেশ – সেখানেও যে বছর বছর পঞ্চাশ হাজার লোক নিজেই নিজেকে মেরে ফেলেন সেটা নিয়ে কি বলবেন?

কথাটা হল, হয় না, হয় না, ওইভাবে যায় না ডিপ্রেশন। আমরা একে অপরকে কিংবা নিজেকে judge করবার যে মাপকাঠিটা তৈরি করে রেখেছি, গলদটা সেখানেই। ধরুন, পুরানো স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে একটা মিট হল। অনেক বছর পরে দেখা। তো আসলে হচ্ছেটা কি? সবাই মনে মনে ফিতে নিয়ে এসেছে। কে কতটা কত বড় চাকরি পেয়েছে, কে কার মেশমশাইএর ব্যবসায় গুছিয়ে বসেছে, কার বউ কতটা সুন্দরী হয়েছে, কার ছেলে জেলায় ফার্স্ট হয়েছে – এইসবই মাপা মাপি চলবে। আপনি বা আমি কেউই একবারও জিজ্ঞেস করব না, কিরে কত কেজি সুখ জমালি? আসলে আমরা সব কিছু মাপিই টাকা দিয়ে, অ্যাচিভমেন্ট দিয়ে। কে কতটা সুখি তা দিয়ে নয়। আমাদের শিক্ষাই দেওয়া হয় কীভাবে সফল হব জীবনে সেটা নিয়ে। কীভাবে সুখি হব তার শিক্ষা আমরা পাই কই?

যাক গে, এতটা পড়ে ফেললেন। আপনার যদি একটা আলবাল লোকের এই লেখাটা পুরোটা পড়ার অবকাশ থাকে, তার মানে আপনার বেসিকটা আছেই। এবার সেটা নিয়ে আপনি সুখি থাকবেন, নাকি depressed হবেন, সেটা আপনিই পারেন ঠিক করতে। সুখি থাকাটা আসলে একটা আর্ট। আর হ্যাঁ, সব্বাই মায়ের পেট থেকে আর্টিস্ট হয়ে জন্মায় না। তাই শেখাতে হয়। হুম, কেমন করে সুখি হব, এটা একটা শিক্ষণীয় জিনিস – একটা আর্ট। 

Take home message টা তাহলে কি দাঁড়ালো? লোকটার সামনে আধ ভর্তি একটা গ্লাস ছিল। কিন্তু উনি ভাবলেন, গ্লাসটা আধখানা খালি। আপনি অমনটি করবেন না কো। Move on.

আরও কয়েকটা মজার তথ্যঃ

উইকিপিডিয়া থেকে পাওয়া এই হিসাবটা বলছে, ইউরোপে নাকি আফ্রিকার থেকেও লোক বেশি সুইসাইড করেন।  সুত্রঃ উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Scroll to Top