কালকে একটা অংশের হাজার হাজার মানুষের জীবনটা অনেকটা তছনছ হয়ে গেছে। এই ক্ষতিগুলো আদতে অনুভব করা যায় না। উপড়ে যাওয়া বড় বড় গাছ আর ভেঙে পড়া ঘর বাড়ি দেখে অনেকটা অনুমান করতে পারা যায় ঝড়ের তাণ্ডবটা। কিন্তু একটা ঘর ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো দশ বছর ধরে ধরে তিল তিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্ন গুলো কীভাবে এক দমকায় পুরো ছারখার হয়ে যায়, সেটা অনুভব করা যায় না। অনুমান করা আর অনুভব করা এক জিনিস তো নয়। আমিও পারি না।
রহিম কাকা ভেবেছিলো এবছর ফসলে দাম পেলে মেয়ের বিয়েটা দিয়েই দেবে। সে ফসল মাঠে জলের তলায় পচে যাবে। ফসল নাকি দুদিনেই পচে যায়। দুদিন? গরীব মানুষের স্বপ্নের জীবনকাল দুদিন? তপন বলছিল ওদের বাড়িতে নাকি খড়ের ছাউনি তুলে এবার এসবেস্টস দিয়েছে। আর বছর তিনেক পরে ইচ্ছে আছে পাকা করবে। সেই অনেক বছরের স্বপ্ন দিয়ে গড়া এসবেস্টস উড়িয়ে নিয়ে গেছে উম্পুনে।
এগুলো সব বানিয়ে লেখা। কল্পনা করে। মুম্বাই বসে খবরের কাগজ আর ফেসবুক ফরোয়ার্ড পড়তে পড়তে রাগ দুঃখ হতাশা জমে পাহাড় হয়। রোজই হয়। কিন্তু কি করব, সেই সব অবজ্ঞা করেই নিজের জীবন গুছিয়ে রাখতে হয়। ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ যে। কিন্তু এক এক দিন এতটা নিতে পারি না। তখন তার খানিকটা উগড়ে দিয়ে যাই ফেসবুক দেওয়ালে।
অনেকে সেগুলো বাঁকা চোখে দেখে। দেখবেই না কেন। কিন্তু কি করব। বড় হতে হতে নিজেরটা বুঝে নিতে শিখেছি। তাই বলে আবেগ অনুভুতি মরে তো যায় নি। গেলে বেঁচে যেতুম। আরও একটা নাকিকান্নার পোস্ট দিলে কারোর কিছু লাভ হয় না, কিন্তু নিজের ঘুম টুকু আসে। নইলে ভয় হয় পাছে বিপ্লবী হয়ে উঠি। শিক্ষা মানে চেতনা, চেতনা মানে বিপ্লব, বিপ্লব মানে মুক্তি – তাদের জন্যে, যাদের নাম ইতিহাসের খাতায় উঠেছে; আরও হাজার হাজার জনের জন্যে বিপ্লব মানে মৃত্যু – সে বড় ভয়ঙ্কর।
কিন্তু বড্ড খারাপ লাগে লোকে যখন রাগ দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে আরও ভয়ঙ্কর কিছুর আশ্রয় নিয়ে বসে – নিজের অজান্তেই। রাজনীতির দাদারা তো নিজেদের আখের গুছাতেই আমাদের মধ্যে বিভেদ লাগিয়ে দেবেনই। তাদের সমালোচনা করুন। জাবদা খাতায় লিখে রাখুন। পরের বারে ভোট দেবার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নেবেন।
কিন্তু তাই বলে দোহাই, এরকম হুট হাট বাঙালি অবাঙালি দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দেবেন না। এগুলো সবই খুব ভয়ঙ্কর। ভারত-পাকিস্তান, হিন্দু-মুসলিম, সেকুলার-মাকু, এইসব গুলোই আসলে ওই রাজনৈতিকদেরই তৈরি ফাঁদ। জানি খুব দুঃখ হচ্ছে, রাগ হচ্ছে, হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে গিয়ে ওদেরই তৈরি ফাঁদে পা দেবেন না। কংগ্রেস ছিল, চলে গেছে, সিপিএম এসেছে চলে গেছে, তৃণমূল আছে, হয়তো একদিন চলে যাবে, কে জানে হয়তো বিজেপিই আসবে কিনা। কিন্তু তারাও চলে যাবে… অথচ আমরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে লড়তে থাকব কেউ হিন্দু হয়ে, কেউ মুসলিম হয়ে, কেউ বাঙালি হয়ে, কেউ আবাঙ্গালি হয়ে। এগুলো বড় অদ্ভুত জিনিস। এটা এক ঘণ্টায় মারে না, এটা তিল তিল করে ধসিয়ে দেয় একটা জাতিকে, তার পুরো কালচারকে।
এসব লেখায় রহিম কাকার বা তপনের বাবার কিছু হবে না। তবে মধ্যবিত্ত এই যুবকটার চোখে ঘুম আসবে। এরই মাঝে সাগরদিঘিতে কিংবা পাথরপ্রতিমায় কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই হয়তো স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। সরকারের ত্রাণ আসবে, দোতলা এবার তিন তলা হবে। রহিম কাকারা আবার সব ভুলে ঘর বাঁধা শুরু করবে – ওদের কাছে ত্রাণ পৌঁছায় না। ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারের গুর গুর আওয়াজ পৌঁছায়- হয়তো। নিজেরটা নিজেকেই বুঝে নিতে হয় – ওদেরকেও।
Pingback: আরেকটা বৃষ্টির গল্প - ২৩ শে জুন, ১৭৫৭ - স্বগতোক্তি