বর্ষা কালে বৃষ্টি হবে, এ আর এমন কি। বিশেষত সেটা যদি একটা নিরীহ কয়েক ঘণ্টার হয়, যেমনটা হয়ে থাকে প্রতি জুন মাসেই, আমাদের বাংলায়। কিন্তু এমন কত তুচ্ছ ছোট ঘটনা কি করে যে লিখে দিতে পারে একটা দেশের ২০০ বছরের ইতিহাস, ভারি অদ্ভুত লাগে ভাবতে। তারই গল্প পড়ছিলাম আজ।
দিনটা ২৩ শে জুন। তবে সালটা ১৭৫৭। পলাশীর প্রান্তরে মুখোমুখি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ, আর ব্রিটিশ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ।
ভোর হয়েছে। শিবিরের মাথায় চড়ে ক্লাইভ তো থ। এত সেনা তিনি ভাবতেই পারেন নি। ৫০ হাজার পদাতিক সৈন্য। ১৮ হাজার অশ্বারোহী। আর ৫০ টা বড় বড় কামান! তার সঙ্গে আরও কামান নিয়ে প্রস্তুত আছেন ৫০ জন লালমুখো সাহেব – না এরা ইংরেজ না; ফরাসী। মিরজাফরের সঙ্গে আগে থেকে না হয় ষড়যন্ত্র করে রাখা আছে। তাতে না হয় এই বিপুল বাহিনীর অর্ধেক লোক আসলে যুদ্ধ করবেই না। কিন্তু বাকিরা? নবাবের প্রচণ্ড বিশ্বস্ত আর সবচেয়ে তুখোড় সেনাপতি মীর মদন আর মহনলালই তো মুখিয়ে আছেন ৫ হাজার অশ্বারোহী আর ৭ হাজার সেনা নিয়ে। মোটে ৯০০ সাহেব আর ২১০০ সেপাই নিয়ে কি করে কি লড়াই দেবেন – ভাবতে ভাবতে নেমে এলেন ক্লাইভ।
যুদ্ধ শুরু হল সকাল ৮ টায়। ইংরেজরা সংখ্যায় নগন্য, তবে ভরসা একটাই, তাদের অবস্থানটা খানিক সুবিধাজনক জায়গায়। কিন্তু কিছুতে কিছু হয় না। নবাবের বড় বড় কামানের গোলা রহ রহ উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। আধ ঘণ্টাতেই মারা গেছে ১০ ইংরেজ সেনা আর ২০ সেপাই। এগোবার প্রশ্নই নেই, ক্লাইভ নির্দেশ দিলেন পিছু হঠার।
জরুরী মিটিং ডেকে ঠিক হল, এভাবে সংখ্যায় পেরে ওঠা যাবে না। মাঝ রাতে কিছু করা যায় কিনা দেখা যাবে।
তার খানিক পরেই আসরে হাজির বরুণ দেব। কোথায় সূর্যের আড়াল থেকে চুপিচুপি রঙ্গ দেখবেন, তা না, তার মুড হল, একটু খেলে আসি। ভরদুপুরে শুরু হল ভারী ঝড় বৃষ্টি। আর তাতে ভিজে গেলো নবাব পক্ষের গোলা বারুদ।
বৃষ্টি থেমে এসেছে। মীর মদন ভাবলেন, এই তো সুযোগ, বারুদ নষ্ট, এবার তেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়া যাক ঘোড়া বাহিনী নিয়ে। তরবারির কোপে খানখান হয়ে যাবে শত্রুদের মাথা। তার জানা ছিল না, তাদের বারুদ ভিজে গেলেও, ইংরেজদের ভেজেনি। তারা যে ত্রিপল নিয়ে প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। কামানের একটা গোলা শেষ করে দিলো মীর মদনকে। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো তার বাহিনী।
এরপর আর কি! মীর জাফর, রায় দুর্লভের ষড়যন্ত্র সব বাঙালিই জানে।
কিন্তু আমি ভাবছি, এই বৃষ্টিটা সেদিন যদি না হত?
উম্পুন এসেছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্যে। কিন্তু সেই ঝড়েই তচনচ করে দিয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষের জীবন। ফেশবুকে এক একটা করুন ছবি দেখি, আর থম মেরে বসে থাকি। ঝিমুনি আসে। প্রকৃতির কয়েক ঘণ্টা এই মানুষ গুলোর কত বছরের ভাগ্য রেখা নতুন করে লিখে দিয়ে চলে গেলো। এই ভাঙা ঘর জুড়তেই হয়তো কেটে যাবে একটা প্রজন্ম।
কিন্তু এ আর আশ্চর্য কি। প্রকৃতির কাছে পুতুল আমরা। আধ ঘণ্টার খামখেয়ালিপনায় সে লিখে দিতে পারে একটা দেশের পরবর্তী ২০০ বছরের ইতিহাস। সেই ২০০ বছর থেকে বেড়িয়ে আসতে আরও কত শত বছর পেরিয়ে যাবে, সে হিসেব নাহয় রাখবেন ইতিহাসবিদরা।
তথ্যসূত্রঃ
১) উইকিপিডিয়া
২) Orme, Robert (1861), A History of the Military Transactions of the British Nation in Indostan from the year MDCCXLV, II, Madras: Athenaeum Press, OCLC 46390406
একইরকম আরও কিছু আর্টিকেলঃ
১) উম্পুনে কলকাতা – উত্তর কোরিয়াও জ্ঞান দেয় মাঝে সাঝে!
২) গরীবের স্বপ্ন আর উম্পুন