“রাম মন্দির এর ইট পাতা হল। ফেসবুকে তো …”
সুমনের কাছে এটা একটা প্রিয় টপিক হবে ভেবে কথাটা পাড়তে গেলাম, ব্যাটা খচে উঠল, রাম রহীম নিয়ে তোদের এই ঘ্যানঘ্যানানি রাখ তো।
অগত্যা, ব্যর্থ মনোরথে বাদশার লেটেস্ট ভিডিও দেখতে বসলুম।
হঠাত সুমনের স্বগতোক্তি, আজকাল এই যে সবাই খুব বিজ্ঞ হয়ে ধর্ম নিয়ে নাক সিটকানি শুরু করেছে, এটা জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না।
আমি উঠে বসলাম। যে নিজে ভগবান মানে না তার মুখে এ কি ভাষ্য শুনি!
সুমন বলে চলল, দেখ ধর্ম, ঈশ্বর, এসব চিরকালই বিজ্ঞ লোকেদের কাছে গুরুতর টপিক। কিন্তু আজকাল এই যে সব আলবাল লোকে…
আলবাল কথাটা উচ্চারণ করতেই কেন জানি না আমার নিজের গায়ে লাগল। আমি মাঝখানেই থামিয়ে বললুম,কেন ?ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যায় হয় নি? রাজনীতি হয় নি? লোক মরে নি? বেশি দূর যেতে হবে না, অযোধ্যা, গুজরাত নাহয় বাদ দিলুম, আমাদের বাঙালি হিন্দু রাজা শশাঙ্কই তো কত বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মেরেছেন।
সুমনের মুচকি হাসি দেখে চুপসে গেলুম খানিক। আসলে এইসব তথ্য ওর থেকেই শোনা।
সুমন শান্ত স্বরে বলল, ভাই, এই সবই মোটা দাগে লেখা রয়েছে ইতিহাসে। এবং আজকাল সবাই তার ওপরে লাল পেন্সিল দিয়ে আন্ডারলাইন করে দিচ্ছে। এই সবের চক্করে যে প্রশ্নটা কেউ করছে না — ধর্মে নাহয় না, কিন্তু তার শূন্যস্থানে কি?
আমি বললুম, মতলব?
মানে এই যে ধর আমাদের পারুল জেঠিমা। কত কিছু করেও ছেলে হল না। কিন্তু গোপাল নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিলো সারা জীবন। তারপর, এই ধর এই যারা চোদ্দ পুরুষ আধ পেটা খেয়েও বেঁচে থাকছে, অথচ চোর ছ্যাঁচোড় হচ্ছে না, …
আমি থামিয়ে দিতে বাধ্য হলুম। ভাই, লোক ডাউনে তোর মাথাটা ডাউন হয়েছে। তোর মুখে এই লেভেলের লজিক?
সুমন একটুও অপ্রতিভ না হয়ে বলে চলল, এইখানেই গণ্ডগোল ভায়া। প্রচণ্ড দুঃখ কষ্টের মাঝেও মানুষ বেঁচে থেকেছে এই ভেবে যে একদিন ভগবান মুখ তুলে চাইবে। সমাজের সমস্ত অন্যায় অবিচারের বোঝা বয়েও অসামাজিক হয় নি। আগের জন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্ত বলে মেনে নিয়েছে সে। ঠিক এই জিনিস গুলো ইতিহাসে লেখা থাকে না। আপামর লোক সাধারণের মরালীটি বল, বিবেক বল, আশা, ভরসা, কিংবা বুকের বল – এ সব এত দিন ধর্মের কল থেকেই তৈরি হয়েছে। যে লোকটা পণ্ডিত, তার এই আফিঙটা লাগে না। পাতি মানবিকতার লজিক দিয়েই তার মানসিকতা সেট হয়ে যায় ঠিক জায়গায়। কিন্তু যে লোকটা মানবিকতাটা ঠিক অন্তরস্থ করে উঠতে পারে নি, আবার ধর্মটাও ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিতে শিখেছে, সে কোথায় দাঁড়াবে সেটা হিসেব কষে দেখেছিস?
বুঝলাম সুমন তার ট্রেডমার্ক চৌহদ্দিতে ঢুকে গেছে। এসব আমার মাথায় ঢুকবে না আর।
তাও নিজেই উৎসাহ নিয়ে বলে চলল, মডার্ন সমাজের, বিশেষত ভারতের মত দেশে, যেখানে প্রযুক্তি আর তার হাত ধরে ইনফরমেশন আগে আগে এসে গেছে, অথচ মূল্যবোধের শিক্ষাটা ঠিক তারে বাঁধার ব্যবস্থা হয় নি, সেখানে পুরো পাবলিকের একসঙ্গে এই উন্নাসিকতা ভয়ঙ্কর। আজকের সমাজে অনেক কিছুর যে অবনমন দেখতে পাস, তার মূলে হয়তো এটাই, যে আজ আমরা ধর্মেও নেই, জিরাফেও নেই।
আমি কনফিউজড হয়ে গেলুম। তাহলে তুই বলছিস, এই যে মসজিদ ভেঙে মন্দির হচ্ছে, গোমাতার মূত্র খেয়ে মুসলিম পেটাচ্ছে, অথবা জিহাদের নামে মানুষ মারছে – এগুলো বেমালুম গিলে নেব?
সুমন বলল, আমি তো সেটা বলছি না। কথাটা হল, কয়েকটা ডাল পচা বলে পুরো গাছ মূল সুদ্ধ উপড়ে দিস না। আগে কিছু নতুন চারা গাছ পোঁত, তাতে জল দে, সে বড় হোক। বুড়ো গাছ এমনিই মরে যাবে তত দিনে।
বললুম, বুঝলাম না। আবার হেঁয়ালি? তা তুই কি আজকাল পূজা অর্চনাও শুরু করলি নাকি?
সুমন খেঁকিয়ে উঠল। যা, আর জ্বালাস না। আর হ্যাঁ, ফেসবুকে আবার স্ট্যাটাস মারিস না। পারলে আলেন ডি বটনের কয়েকটা লেকচার শোন ইউটিউবে।
কি কাণ্ড বলুন দিকি। সাত কাণ্ড রামায়ণ হয়ে যাচ্ছে। আর আমি দেবো না স্ট্যাটাস? স্ট্যাটাস দেবো না?