স্বগতোক্তি

অধ্যাপক, ছাত্রী, আর আমরা

১)

সুলোচনার প্রেমে পড়েছিলাম তার প্রখর যুক্তিবাদী মনোভাবে আকৃষ্ট হয়ে। কত আপাত তুচ্ছ ঘটনাকেও অত সূক্ষ্মভাবে বিচার করতে কাউকে দেখি নি। আর আমার যা স্বভাব, যুক্তিতে হেরে গেলেই দুম করে প্রেমে পড়ে যাই।

সুলোচনার প্রেমে পড়েছিলাম তার চোখ দুটোর জন্যে। তার সঙ্গে ঠোঁটের কোণে ওই ছোট্ট তিল। মনে হয়েছিল ওই মুখশ্রী আমার চাইই চাই। এতে কেউ কিছু দোষ দেখতে না পেলেও চশমা আঁটা তাত্ত্বিকরা কিন্তু বলতেই পারেন, বাছা, তুমি গুণ নয়, রূপে মজেছ। প্রেমের মাপকাঠিতে এটা একটু কম নাম্বার পেলেও চোখ আর তিল কিন্তু কাব্যেও ভারী রোম্যান্টিক।

এবার ধরুন, চোখের জায়গায় বুক, আর তিলের জায়গায় নিতম্ব লিখলাম। সবাই এখনই রে রে করে না উঠলেও, ধমক দেবেই হালকা – ‘এমন কথা কেউ লেখে?’ অবশ্য এমনটা খুব বেশি লোক বলবে না যে, ‘এরকম করে কেউ ভাবে?’ কাব্যের মাপকাঠিতে খানিকটা খাটো হলেও এ প্রেমও সমাজে মান্যতা পায় দিব্যি। আর বায়োলজির যুক্তি খাড়া করে আমরা এভাবে ভাবনাটাকে চলনসই মেনেও নিয়েছি।

এবার আমি বললাম, সুলোচনার প্রেমে পড়েছিলাম ওর বাবার অত বড় মহল্লা দেখে। এখন আপনি নিশ্চয় ভাবতে শুরু করবেন, ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’ সামনাসামনি না বললেও এ সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষো করবেনই।  তবে সুলোচনা বা তার বাবা সেটা না বুঝতে পারলেই এ প্রেম দিব্যি বিয়ে, বিয়ে থেকে সন্তান, সন্তান থেকে — মোদ্দা কথা সমাজে দিব্যি নিজের জায়গা করে নেবে। জন মনে খুব বেশি নম্বর না পেলেও এ প্রেমেও অপরাধ বা ক্রাইম নেই।

এখন আমি বলব – একটি কন্যা থাকা সত্ত্বেও আমি বিবাহিতা সুলোচনার প্রেমে পড়েছিলাম। এইখানটায় আমি গণ্ডগোল করে ফেললাম। এবার কিন্তু আমি অপরাধের গণ্ডির মধ্যে চলে এলাম। এটা অপরাধ – অন্তত বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে। তাও জানি, এর জন্যে নিশ্চয় ফাঁসি দেবেন না।

ফাঁসি দেবার কথা না ভাবলেও অন্তত জেলে তো পুরবেনই, যদি বলি, এরকম আরও সুলোচনার প্রেমে পড়েছি আমি। এবং প্রেম থেকে —-

যাক গে, এত ইনিয়ে বিনিয়ে যেটা বলতে চাইছি সেটা হল, এ দোষী, ও নির্দোষ – জীবনটা এরকম কোনও স্কুল পরীক্ষার True or False কোশ্চেন নয়। জগত ধূসর – সাদা কালো না। আমরা কোনও না কোনও ভাবে সবাই নেগেটিভ। নেগেটিভিটির একটা একটানা স্কেল আছে। সমাজ অস্পষ্ট ভাবে হলেও একটা জায়গা দাগিয়ে রাখে, যার একদিকে থাকলে আপনি অপরাধী, অন্য দিকে থাকলে নিরপরাধ। কিন্তু অপরাধেরও মাপকাঠি আছে। নেগেটিভ স্কেলের প্রান্ত বিন্দুতে যে আছে, তার সঙ্গে যে সবে ক্রশ করে ফেলেছে, দুজনের অপরাধ সমান চোখে দেখলে চলে না।

এইসব কথাই সাম্প্রতিক একটা অডিও ক্লিপ নিয়ে। একজন প্রথিতযশা কবি-অধ্যাপকের প্রেমে পড়া ইউনিভার্সিটি ছাত্রী আর ওই স্বনামধন্যের স্ত্রীর কথোপকথনের রেকর্ড ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। এ জিনিস খুব কম হয়তো নয় আমাদের সমাজে – তবে রসালো। তাই এ জিনিস নিয়ে অচিরেই কিছু তোলপাড় হবে –  সেরকমই অনুমান। তবে আমার বক্তব্য অলরেডি দের লক্ষ ভিউ পাওয়া এই ভিডিও নিয়ে না। বরং তার কমেন্ট নিয়ে।

২)

প্রায় সব কমেন্টে একটাই কথা – অধ্যাপক মশাই দোষী বটে, কিন্তু মেয়েটিও কম না। এক হাতে তালি বাজে না। অধ্যাপক স্ত্রী ঠিকই বলেছেন, কেরিয়ার গড়ার লোভ নিয়ে এরকম লোকের চরিত্র জানা সত্ত্বেও এ মেয়েরা নিজে থেকেই এগিয়ে আসে।

ওপরের সব কথাই সত্যি (হয়তো) – কিন্তু সব সত্যিই যথার্থ না।

ক)

প্রায় সব কমেন্টই এক কথা বলে- শুধু লোকটিকে না, মেয়েটিকেও দোষ দাও। সবাই যখন একই কথা বলছে, সবাই তো বুঝেই গেছে মেয়েটিও দোষী। তার পরেও এটা আলাদা করে কেন বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে যে মেয়েটিও দোষী? মেয়েদের দোষ দেখলে বুঝি খুব মজা লাগে?

কবিতা শুনে আপনি প্রেমে পড়তেই পারেন। ঠিক একই কারণে অধ্যাপকের স্ত্রীও প্রেমে পড়েছিলেন। এবং অনেক কিছু বুঝে ফেলেও মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি – নিজেই আপসোস করেছেন। কিন্তু সেটা অপরাধ ছিল না। সে বয়সের immaturity বললেও বলা যায়। কিন্তু মোদ্দা কথা, মোহ বা প্রেম জিনিসটা নিজে থেকে খুব অস্বাভাবিক না। তার সঙ্গে কিছু পাওয়ার আশা জুড়ে গেলে সেটা অবশ্যই খারাপ জিনিস। এবং সব জেনে শুনেও একটা পারভারটের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন অবশ্যই প্রমাণ করে, মেয়েটি ধোয়া তুলসী পাতা না। 

মানা করা সত্ত্বেও আনাড়ি ছেলেটা রাস্তায় বেরিয়ে দু পক্ষের গলাগুলির মাঝে পড়ে পায়ে গুলি খেলো। আপনি রাগের মাথায় বলতেই পারেন, বেশ হয়েছে, মানা করেছিলাম তো যে বেরোস না। কিন্তু তাই বলে ওই গুণ্ডা গুলোর অপরাধ খালাস করে দিতে পারেন না। উদাহরণটা জুতসই হল না।

কিন্তু বড় কথা, মেয়েটি আরও দশ জনের সঙ্গে প্রেম করেনি। তার অপরাধ আর এই লোকটির অপরাধ এক মাপের নয়। স্বার্থ বা মোহের প্রেরণায় একজনের সঙ্গে প্রেম, আর ছলে বলে কৌশলে (বা কবিতায়) অনেক অনেক মেয়েকে ফাঁদে ফেলা এক জিনিস না। সবার আগে আমাদের এই লম্পটটিকে সাজা দেওয়া উচিৎ।

খ)

‘এক হাতে তালি বাজে না।’ ভালো কথা।

অনন্যা তালি বাজিয়েছে ৫০ মার্ক্স। অধ্যাপক ৫০ মার্ক্স।

নীহারিকা তালি বাজিয়েছে – নীহারিকা ৫০ মার্ক্স, অধ্যাপক মশাই আরও ৫০ মার্ক্স।

এরকম তালির হিসাব টাও যদি গুছিয়ে করেন, তাহলেও বুঝতে পারবেন এই পুরুষটির দোষের মার্ক্স অন্য সব মেয়েগুলোর থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি।

গ)

এত কথা কেন? আসলে ঠিক এই রোগটাই যত নষ্টের কারণ। আমরা, মানে সমাজের আর পাঁচটা (আপাত) ভালো মানুষরা এই সহজ তালির হিসাবটা গুছিয়ে করতে পারি না বলেই অনেক মেয়ে মুখ বুঝে মেনে নেয় এসব। অপরাধীরা সাজা পায় না।

আপনি বলবেন, মেয়েটি পাঁচ বছর বলে নি কেন? হয়তো আপনাদের এই মোটা দাগের তালির হিসাবটার ভয়ে। আপনি তালির হিসাব কষবেন জেনেই অধ্যাপক বলতে (হুমকি দিতে) পারেন, তোমার আমার সম্মানের কথা ভেবে তুমি এটা ঠিক করলে?

ঘ)

অনেকে মেয়েটির শান্ত ধীর কথার ধরন নিয়ে ইঙ্গিত করছেন। যেন হাহাকার, কান্নাকাটি, লজ্জা, এইসব ফুটে উঠলেই মেয়েটি যথার্থ মেয়ে বলে পরিগণিত হত। হায় রে আমাদের stereotype ভারতীয় মানসিকতা!

এদিকে অধ্যাপক মশাই স্ত্রী এবং কন্যার পাশে থেকেও বারবার যে সাফাই গেয়ে চলেছেন, তার বেলা? তাঁর যুক্তিটাও অদ্ভুত না? যেন মেয়েটি তাঁকে ‘অ্যাপ্রোচ’ করেছে বলেই তাঁর সব দোষ মাপ। বাকিটা তো তেমন দোষের না – তিনি যে পুরুষ। এক মহিলা আপ্রোচ করবেন, আর পুরুষ হয়ে সে ‘সুযোগ’ তিনি নেবেন না? একজন কবির এরকম জীবনবোধ? আশ্চর্য!

ঙ)

কোথাও আমরা একটা সরলীকরণে বিশ্বাস করে ফেলছি – ছেলেরা দোষ করছে বটে – কিন্তু তার আঁচ বাঁচিয়ে চলা মেয়েদের একান্ত নিজস্ব দায়। এটাই ভয়ঙ্কর। আপনি এখন নারীবাদী বলে গাল দিতেই পারেন। কিন্তু ঘটনা হল আমাদের মানসিকতার বীভৎস চেহারা অটোমেটিক ধরা পড়ে – যখন আমরা পরপর দুটো লাইন লিখি – অধ্যাপক করেছেন ‘ভোগ’, ছাত্রীরা ‘এনজয়’। একই বায়োলজিক্যাল প্রসেসে অংশ নেওয়া দুটো মানুষের ভূমিকাকে দুরকম দৃষ্টি দিয়ে দেখার রোগ এই শব্দ চয়নেই ধরা পড়ে।

“ভোগ” আর “এনজয়” এর সূক্ষ্ম পার্থক্য যত দিন না বুঝতে পারছি, তত দিন না হয় চলুক তালির এই সস্তা হিসাব কষা। বরং আমরা রোগকে পাশবালিশ করে নিতে প্রাকটিস করি। আর অপেক্ষা করি এরকম আরও আরও সৎ সাহসী স্ত্রীর জন্যে।

এসবের মধ্যে ওনার ভূমিকা প্রনম্য। তাঁর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মেয়েটিকে দোষ দেওয়া আর আমার আপনার দোষ দেওয়া এক জিনিস না। ভিডিও শুনে সবচেয়ে কষ্ট হল কখন জানেন? তিনি জানতেন ছেলে যাই হোক, শাশুড়ি মা ভালো মানুষ। কিন্তু যখন বুঝলেন, সব কথা জানা সত্ত্বেও শাশুড়ি মা কিছুই ভূমিকা গ্রহণ করেন নি, তখন তার যে অসহায়তা, সেটা যেন এ সমাজের চাপা কান্না।

Leave a Reply

A Soliloquy
A bilingual blog in Bengali and English. © A Soliloquy