সুতপারা কখনই বলে না।

ধরো তুমি একটা ঢিল ছুঁড়লে আকাশে। শুধু দুটো ইনফরমেশন চাই – এক, কোন বেগে ছুঁড়লে, আর দুই, অ্যাঙ্গেল কত। ব্যস, তারপর মাটিতে পড়ার আগে প্রতিটা মুহূর্তে ঢিল বাবাজি পৃথিবীর কোন জায়গায় থাকবে, দিব্যি বলে দেওয়া যায় অঙ্ক কষে। যারা ফিজিক্স নিয়ে পড়ে, তারা জানে, কিছুই না, নিউটনের গতিসূত্র – সেকেন্ড অর্ডার ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনের এই ধর্ম; দুটো ইনিশিয়াল কন্ডিশন বলে দিলে পুরো সলিউশনটা নামিয়ে দেওয়া যায়।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই আমি, তুমি, রাম, শ্যাম সবাই আসলে সিস্টেমের দাস। হয়তো এখানে ওখানে ইনিশিয়াল কন্ডিশনটা একটু এদিক ওদিক হয়েছে, আর তাতেই জীবন রেখাটা কত আলাদা আলাদা হয়ে গেছে।

১)

আমি ভাবছিলাম বাবলুর মার কথা। বাবলু হল আমাদের এলাকার ত্রাস। কিন্তু তার মা কি আমার বা তোমার মার থেকে খুব আলাদা?

মাঝে মাঝে বাবলু রাতে বেরিয়ে যায়। কোমরে কি একটা কালো জিনিস গুঁজে নেয়। বাবলুর মা এখন জানে ওটা পিস্তল। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। কিন্তু তাও কিছু বলতে পারে না। প্রথম প্রথম যখন বলত, খ্যাঁক করে উঠত বাবলু – তুমি যেটা বোঝো না মাথা গলিও না। অপারেশন আছে। না গেলে মিন্টু দা নাকি কেলো করে দেবে।

বাবলুর মা দরজাটা বন্ধ করে দেয়। এই রাত গুলোয় ঘুম আসে না। আসলে আগে একদমই আসত না। আজকাল তাও কেমন যেন অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। বাবলুর মা খুব করে ঠাকুরের নাম ডাকে। বুকটা দুরুদুরু করে। ঠাকুর, ওর আবার কিছু যেন না হয়ে যায়।

ঠাকুর বাবলুর মাকে নিরাশ করে না। ভোর রাতে বাবলু ফেরে। তারপর ব্যাগ পত্তর নিয়ে বেরিয়ে যায়। বাবলুর মা জানে, এখন প্রশ্ন করতে নেই কোথায় যাচ্ছে। বাবলু সময় হলে ফিরে আসবে ঠিক। কত দিন লাগবে সেটা নির্ভর করছে অপারেশন কত গুরুতর তার ওপরে। বাক্সে কয়েক হাজার টাকা রেখে গেছে বাবলু। সে দিয়ে তত দিন ঠিক চলে যাবে।

পরের দিন বাবলুর মা কল তলায় গিয়ে শুনতে পায়, পাশের গ্রামে শ্যামল ডাক্তার খুন হয়েছে। বাবলুর মার কাছে সব পরিষ্কার – শক্ত করে দাঁত চেপে রাখে। জল নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসে। দরজা বন্ধ করে দিয়েই ভেঙে পড়ে ঘরের কোণে রাখা রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তিটার সামনে।

আবার সব ঠিক হয়ে যায়। বাবলুর মা উঠে ঝাঁট দেয় উঠানে।

২)

বাবলুর ভয় হচ্ছিল ট্রেনটা লেট করবে কিনা। মিন্টু দা আগেই টিকিট কেটে রেখেছিলো। এবারে সোজা ধানবাদ গিয়ে নামতে হবে। ঠিকানা, ফোন নাম্বার সব লেখা আছে। ট্রেন ছাড়তে বাবলু বুকে একটু বল পেলো।

জানালার ধারে পেয়েছে সীট। বাইরে দিয়ে ছুটে ছুটে যাচ্ছে গাছ পালা, ঘর বাড়ি, ঘরের ছাদে দড়ি থেকে ঝোলানো  শার্ট, প্যান্ট,শাড়ি, সায়া। কাল রাতে খুব ধকল গেছে। বাবলু অবশ হয়ে আসে।

ফ্ল্যাশ ব্যাকে ভেসে আসে পুরানো স্মৃতি। কোথা থেকে কি যেন হয়ে গেলো। বাবা যখন মারা গেলো তখন সে জোয়ান ছেলে। অথচ কিছুই কাজ জোটাতে পারে নি। মিন্টু দার ক্লাব ঘরে বসে তাস খেলত আর ফাইফরমাশ শুনত।

একদিন মিন্টু দা ডেকে নিলো একান্তে, অপজিশনের রাতুল বাবু নাকি খুব বাড়ছে। পরের বারে ভোটে রমেন দত্ত হেরেও যেতে পারে। রমেন দত্ত মিন্টু দার গডফাদার। তাই রাতুল কে একটু কড়কে দিয়ে আসতে হবে। ওর মেয়েকে তুলে দুদিন রামলালের গুদামে ধরে রাখতে হবে। তারপর রাতুলের সঙ্গে ডিল পাকা হলে ছেড়ে দেবে।

বাবলু এতটা খারাপ কাজ করবে কখনও ভাবে নি। আগের বার ভোটের আগে দলের ছেলেদের সঙ্গে ঘরে ঘরে গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছিল মিষ্টি সুরে। সেটা তেমন কিছু মনে হয় নি। বাবলুর ভারী গলা শুনে যখন বুড়ো বুড়ি গুলোর গলা শুকিয়ে যায় বাবলুর একটু যেন অহংকার হয়। সেই থেকেই মিন্টু দার নেক নজরে। এ ছেলের মধ্যে মাল আছে।

কিন্তু তাই বলে – কিডন্যাপ? তাও একটা সোমত্ত মেয়েকে? বাবলুর মনে কু ডাকে। এসব আমায় দিয়ে হবে না বলে দেয়।

বুঝতে পারে মিন্টু দা ব্যাপারটা ভালো করে নেয় নি। বাবলুর মুশকিল হল তার গলাটা এমনিতেই ভারী। সময় বুঝে কোমল কিছুতেই করতে পারে না। পরের দিন গিয়ে দলে ভেড়ে। হরি, কুন্তল, রমেশ সবাইই আছে অ্যাকশনে, দেখে বাবলু ভরসা পায়।

তারপর কত দ্রুত সব বদলে গেলো। ওরা সে রাতে খুব মদ খেয়েছিল। গুদাম ঘরে বড়সড় কাণ্ড ঘটে গেলো।

কেস অনেক দূর গড়িয়ে গেলো। শেষে রাতুল বাবুর ছেলেকে সরিয়ে দিতেই হল যাতে মামলাটা উঠে যায়।

তারপর আর কি। একটা খুন ঢাকতে আরেকটা করতে হয়। মিন্টু দা এখন রমেন দত্তের ডান হাত। আর বাবলু তার সব চেয়ে বিশ্বস্ত সাগরেদ।

তার জীবনটা আর পাঁচটা ক্লাবের ছেলেদের মতই। মদ মাংস আর মাঝ রাত অবধি তাস পেটা। শুধু মাঝে সাঝে এরকম এক একটা অপারেশনের দিন আসে। তারপর অনেকটা দিন অনিশ্চয়তায় কাটে। তারপর আবার ঠিক হয়ে যায়।

মাঝে মাঝে এসব ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সম্ভব না, জড়িয়ে গেছে। তার নামে এখন ১৭ টা মামলা। রমেন দত্ত হেরে গেলে পুলিশ পরের দিন তুলে গুম করে দেবে। রমেন দত্তকে জেতাতেই হবে। আর তার জন্যে —

বাবলু ভাবে, ভেবে দেখতে গেলে ওই শুরুর একটা দুটো মাসই সে নিজে ডিসিশন নিয়েছিল। তারপর কখন যে সে সিস্টেমের দাস হয়ে গেছে, বুঝতেই পারে নি। এখন সে নিজে কিছুই করে না। সব যেন সিচুয়েশন করিয়েই নেয়।

এই যে শ্যামল ডাক্তার। এত কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা। মোড়ের কাছে ওই তিন কাঠার প্লটটা ছেড়ে দিলে কি যায় আসত? মিন্টু দা তো অর্ধেক শেয়ার দেবে বলেছিল। ওখানে ফ্ল্যাট গুলো তুলতে না পারলে এত বন্দুক, রাইফেলের খরচই বা আসবে কোথা থেকে। দলে এত গুলো ছেলে – তাদের রুটি রোজগারও তো আছে।

উল্টে ওর কে একটা শালা নাকি হাই কোর্টের অ্যাডভোকেট আছে। তার প্ররোচনায় মালটা মামলা ঠুকে দিলো! অগত্যা লোকটাকে সরাতেই হল।

৩)

তিন দিন পেরিয়ে গেছে। উঠানে বসে বড়ি দিচ্ছে বাবলুর মা। বাবলু শুক্তো খেতে ভালবাসে। আর তাতে বড়ি না দিলে গোসা করে। এমনি সময়ে তিনজন পুলিশ এলো।

বাবলুর মা শক্ত হয়ে যায়। বাবলু তো অর্ধেক বছর এখানে থাকেই না। এখন কোথায় আছে জানি না। পুলিশরাও জানে, এটা রুটিন চেক আপ। আসামি ফেরার লেখার আগে জাস্ট একবার ঢুঁ মেরে গেলে এফ আই আরে মিথ্যে কথা দুটো কম লিখতে হয়। বেশি ঘাঁটায় না। ওরা চলে যায়…

ফিরে যাওয়া বুটের আওয়াজ শুনতে শুনতে চোখে জল আসে – বাবলুর মার। ঠাকুর, সব ঠিক করে দাও। আগের বছর মনসা তলায় মানত করেছিল, ছেলে বিপথ থেকে সরে এলে একটা পাঁঠা বলি দেবে। আর একটা বউ আনবে ঘরে।

কিন্তু একদিনও তার মনে হয় নি, যাই থানায় বলি ছেলের কুকর্মের কথা। পাড়ার সবাই আড়ালে বাবলুর মাকে দোষ দেয়। তার চোয়াল শক্ত হয়। কিন্তু তাও, কখনই মনে হয় নি থানায় গিয়ে সব বলে দিই। সব পাপ ধুয়ে যাক। এত গুলো মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেলো তার ছেলের হাতে – এসব থেমে যাক। মার অপত্য স্নেহ অন্তঃসলিলা নদীর মত বুকের গভীর দিয়ে বয়ে যায় – সেই তাকে চুপ করিয়ে রাখে।

৪)

এমনি করেই সুতপাও সিস্টেমের দাস হয়ে গেছে।

সুতপার যখন এ বাড়িতে বিয়ে হয়, তখনও জানত না বরের কি কাজ। গ্রামে একটি মাত্র পাকা ঘর। কে যেন বলেছিল ওর বাবাকে – এ টাকা হকের টাকা নয়। ওর বাবা উড়িয়ে দিয়েছিল কথাটা। বড় লোকের টাকা গরীবেরা কবেই ভালো চোখে দেখে। মেয়েটা অন্তত দু বেলা দু মুঠো ভালো মন্দ খেয়ে পরে বাঁচুক।

সৌরভ দাস – সুতপার বরের নাম। প্রায় মাস ছয় পরে সুতপা বুঝতে পারে সৌরভের কাজ। মেয়ে পাচার। সুতপার মনে হয়েছিল বিষ খেয়ে মরে যাবে সে। কিন্তু পারে নি। সৌরভকে কিছু বলা যায় না – যখন তখন কিল চড় উড়ে আসে। মেয়ে মানুষের নাকি সব ব্যাপারে নাক গলাতে নেই।

সুতপা নাক গলায় না। কোনও মাসে ফ্রিজ আসে। কোনও মাসে মাইক্রো ওভেন। এ গ্রামে আর কোনও ঘরে এসব নেই। সুতপা সব সাজিয়ে গুছিয়ে সংসার করে। আজকাল মনেও আসে না এই যে নতুন কানের টা সৌরভ গড়িয়ে দিয়েছে এর জন্যে একটা মেয়ে আজ মুম্বাই এর বস্তিতে — না, সুতপা আর এত ভাবে না।

ওর এখন একটাই শখ। ওর ছেলেটা মানুষ হোক। বাবার থেকে তাকে দূরে দূরে রাখে। ছেলেটা পড়াশুনোয় খারাপ না। সব সাবজেক্টেই টিচার দিয়েছে। টাকা পয়সার অভাব তো সৌরভ রাখে নি।

কত লোকের স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে যে টাকা ঘরে আসে, সে টাকা দিয়েই আরও একটা স্বপ্ন বড় হয়।

কিন্তু না, সুতপা কখনও ভাবে নি, ও থানায় গিয়ে সব বলে দেবে।

৫)

সুতপারা কখনই বলে না। বাবলুর মাও থানায় যাবে না কখনও। কিংবা উমেশ বাবুর ছেলে কখনও গিয়ে বলবে না, আয়কর দপ্তরে চাকরি করা তার বাবা আজ আবার সুটকেস ভরে অনেক টাকা নিয়ে এসেছে।

না, আমরা কখনই শুনি না কোনও বাবা মা থানায় গিয়ে বলেছে তাদের ছেলেদের কুকর্মের কথা। স্ত্রী গিয়ে ধরিয়ে দিয়েছে তার স্বামীকে। কিংবা সন্তান চেয়েছে ধুয়ে যাক তার বাবার কুকর্ম।

ওরা যদি তা করতে পারত, এত সংগঠিত অপরাধ থাকত না দেশে। পৃথিবীটা কত সুন্দর হতে পারত। ওরা কি তবে খারাপ মানুষ?

আমার মনে হয়, না। একই রাগ, অভিমান, ঈর্ষা, হিংসা, লোভ, লালসা, গর্ব, আমাদের সবার ভেতরে। একই অপত্য স্নেহ, একই রক্তের টান, একই ভালো থাকার ইচ্ছা। কিন্তু বুকের ভেতর থেকে সেগুলো কীভাবে বেড়িয়ে আসে, কীভাবে আমাদেরকে নিয়ে কি করিয়ে নেয় আমরা টের পাই না। আমরা যেন হাতের পুতুল। সবাই কখন যেন সিস্টেমের দাস হয়ে যায়।

ওই যে বললাম, নিউটনের সূত্র। শুধু ইনিশিয়াল অ্যাঙ্গেল আর গতিবেগ বলে দাও। ঢেলাটা বাকি প্রতিটা মুহূর্তে কোথায় কত বেগে ছুটতে থাকবে, কোন খানে পড়বে, সব অটোমেটিক। অঙ্ক কষে বলে দেওয়া যায়। ঢেলা তখন সিস্টেমের দাস – গতি জাড্য আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির হাতে বন্দি তার ভাগ্য রেখা।

তার হাতে একটাই অপশন ছিল – জার্নি শুরুর আগে অ্যাঙ্গেল, কিংবা গতিবেগ – একটু বদলে নেওয়া। তাহলে যাত্রাপথ হয়তো একেবারে অন্য রকম হত।  হয়তো কেন, হতই। সেটাও অঙ্ক কষেই বলে দেওয়া যায়।

Leave a Reply

Scroll to Top