করোনা ভাইরাস এবং জুতা-আবিষ্কার

রবি ঠাকুরের জুতা আবিষ্কার গল্পটা মনে আছে?

সেই এক রাজা ছিল। বেচারির পায়ে ধুলো লাগে বলে মনে দুঃখ। তাই দেখে মন্ত্রী সান্ত্রি সবাই মিলে এক হুল্লোড় পাকালে, গোটা রাজ্য থেকে ঝেঁটিয়ে ধুলো বিদায় করবে। হঠাত কারোর একজনের মনে হল, আরে বাবা রাজার পা জোড়া কেবল চামড়া দিয়ে মুড়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

এই লকডাউন ব্যাপারটা বেশ খানিকটা ওই রকম। যার করোনা হয়েছে তাকে ঘরবন্দি না করে দেশ সুদ্ধু সব লোককে ঘরবন্দি করা!!

আপাতত লক্ষ কোটি টাকার ধুলো উড়ানোর পর এই রইলো হাজার কোটি টাকার জুতো। আমার মোটা মাথা। জুতোটা মাপে খাটো হবে, নাকি বড় – সে বিচারের ভার আপনার।

তো বন্দোবস্তটা কীরকম?

এটার মূল বক্তব্যটা হল, যাদেরই পজিটিভ হবে তাদের সবাইকেই আইসোলেট করে রাখো। অবশ্যই ক্রিটিক্যাল রোগীদের হাসপাতালে। এবং বাকিদের নিজের ঘরে না, বরং নিখরচায় সরকারী ‘সেফ হোমে’

রসুন রসুন। জানি বলবেন, বলা সহজ, করা কি চাট্টি খানি কথা? সরকারের তো আর কেউ গৌরি সেন নেই, যে সব্বাইকে নিখরচায় খাবার দাবার দিয়ে বাবুসেবা করবে! তর্ক করার আগে চলুন, সবাই মিলে বাবুসেবার খরচপত্র হিসেব কষে দেখি। 

তার আগে বলে রাখি, এটা কেন গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, যাদের পজিটিভ কেস, তারা কতটা নিয়ম মেনে ঘরবন্দি থাকছেন সেটা জানা বা নিশ্চিত করা দুষ্কর। নিয়ম মানছেন না বলেই তো এত ছড়াচ্ছে ভাইরাস। তাদেরকে নিখরচায় কোভিড সেন্টারে রাখলে এই সমস্যাটা সমূলেই দূর করা যায়।

দ্বিতীয়ত, লোকে কোভিড হলেও পারতপক্ষে সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করেন। কারণ তাহলে পরিবার সুদ্ধু ঘরবন্দি থাকতে হবে। করোনা ভাইরাসে ভয় না থাকলেও করোনা রোগীতে লোকের হেব্বি ভয়। এবং ফলত রোগীর এবং পরিবারের রুটি এবং রোজগার দুইই বন্ধ। সরকার যদি রোগীর ভার নেয়, তাহলে সে সমস্যাটা অনেকটাই সমাধান হয়।

তৃতীয়ত, এর ফলে কোন রোগীর অবস্থা বেশি গুরুতর সেটা বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রোগী যখন হাসপাতালে যাচ্ছেন, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা শেষ অবস্থায়। মূলত এটাই একটা কারণ এত রোগীর মৃত্যুর। সুতরাং কোভিড সেন্টারে হলে সব রোগীকেই মনিটর করা যাবে, এবং নির্দিষ্ট প্রোটোকল মেনে কার কখন হস্পিটালাইজেশান দরকার, সেটা বোঝাও সহজ হবে।

আর সর্বোপরি চতুর্থত, এই মুহূর্তে বঙ্গে অ্যাক্টিভ রোগী প্রায় এক লাখ বিশ হাজার। হিসাব বলছে মূলত ১৫% এর হসপিটালে ভর্তি হবার মত অবস্থা হয়। বাকি প্রায় এক লাখ অ্যাসিম্পটোম্যাটিক বা মাইল্ড সিম্পটোমের রোগীদের মূলত নিয়মিত অক্সিজেন লেভেল আর তাপমাত্রা চেক করলেই চলে। আর সামান্য কিছু ওষুধ। তাদের বন্দোবস্ত সেফ হোমে হয়ে গেলে হসপিটালের বেড গুলো যাদের সত্যিই দরকার তাদের জন্যে সংরক্ষিত রাখা যাবে – যেটা একটা বিশাল বড় ব্যাপার।

এবার জুতোর দামটা কষা যাক।

৬০০ কোটিতে ৫০০ সেফ হোমএক লাখ বেড!

এক লাখ বেড চাই। স্কুল কলেজ সব বন্ধ। রাজ্যের প্রায় ৪৫০০ হাই স্কুল আপাতত ছেড়েই দিন। রাজ্যে কলেজই আছে প্রায় ৫০০। কলেজ প্রতি ২০ টা রুম – প্রতি রুমে ১০ জন রোগী ধরলে প্রত্যেকটাকে ২০০ বেডের সেন্টার বানিয়ে ফেলাই যায়। পাখা, বিদ্যুৎ এগুলোর জন্যে বাজেট ধরার দরকার পড়ছে না। কারণ নর্মাল অবস্থায় এত স্কুল কলেজের যে বিপুল ইলেকট্রিক বিল হত, সেটা এমনিতেই বেঁচে যাচ্ছে। একটা কলেজে ২০০ জনের জন্যে টয়লেটও ম্যানেজ হয়ে যাবে আরামসে।

রইলো বাকি বেড সেটআপ খরচ। একটা গদি, বালিশ, এক জোড়া করে চাদর ওয়ার। তা ধরুন বেড প্রতি ১০,০০০। অক্সিমিটার আর থার্মোমিটার মিলিয়ে সেন্টার পিছু এক লাখ। আরও তিন লাখ অন্যান্য খরচ ধরে ৫০০ সেন্টার মিলিয়ে ইনিসিয়াল খরচ দাঁড়ালো ৫০০*(২০০*১০,০০০+৪,০০,০০০) = ১২০ কোটি।

সেন্টার পিছু কর্মী ১০ জন নার্স1, ১০ জন ওয়ার্ড বয়2, ২ জন ডাক্তারি ছাত্র3, ৮ জন নিরাপত্তারক্ষী4, ২ জন পি আর ও5। ৩২ জনের জন্যে স্যালারি/ভাতা মিলিয়ে প্রতি মাসে দাঁড়াবে মোটামুটি সাড়ে সাত লাখ। ৫০০ সেন্টার মিলিয়ে ৩৭.৫ কোটি।

দিনে মাথা পিছু খাওয়া খরচ ১৫০6,  ওষুধ খরচ ১০০, এক্সট্রা আরও ১০০ ধরে এক লাখ রোগীর জন্যে প্রতি দিন খরচ দাঁড়ালো  ৩.৫ কোটি। ৫০০ সেন্টারে প্রতি দিন ২৫ টা পিপিই  কিট কিনতে ৫০০*২৫*১৬০০= ২ কোটি। সব মিলিয়ে দিনে ৫.৫ কোটি।

সরকারের প্রত্যাশা অনুযায়ী সেকেন্ড ওয়েভ থাকবে দু তিন মাস। তো দু মাস লকডাউনের জায়গায় ৪ মাস সেফ হোম চালাতে মোট খরচ দাঁড়াচ্ছে ৩৩০ কোটি। ৪ মাসের স্যালারি ১৫০ কোটি। ইনিশিয়াল খরচ ১২০ কোটি ধরে গ্র্যান্ড টোটাল দাঁড়ালো ৬০০ কোটি।

অর্থাৎ, প্রায় ৬০০ কোটিতে সবার জন্যে সেফ হোম!

তো এই ৬০০ কোটি টা দেখতে কেমন?

  • মনে আছে সেই তিন হাজার কোটি টাকার বল্লভ ভাই প্যাটেলের কথা? সে টাকায় পশ্চিমবঙ্গের মত প্রায় ৫ টা রাজ্যে সবাইকে কোভিড সেন্টারের আওতায় আনা যায়।
  • কিংবা ধরুন, রাজ্যের ৯ কোটি লোক মাথা পিছু ৭০ টাকা চাঁদা দিলেই এ টাকা ওঠে।
  • এবার একটু আমাদের রাজ্যের বাজেটে উঁকি মারা যাক। পশ্চিমবঙ্গের বাৎসরিক বাজেট প্রায় ২.৫ লাখ কোটি। ৬০০ কোটি মানে ০.২৫ %! মানে সরকার বছরে যেখানে ১০০ টাকা খরচ করে, সেখানে আর মাত্র ২৫ পয়সা খরচ করলেই এই পরিষেবা দিতে পারত।
  • সরকার বছরে স্বাস্থ্য খাতে এমনিতেই প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি ব্যয় করে। এখান ওখান থেকে আরও ৬০০ কোটি যোগ করা কি খুব সাংঘাতিক কাজ?
    • গ্রামে নতুন রাস্তা বানাতে খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি। নাহয় এ বছরটা লোক আগে প্রাণে বাঁচল। ৪% রাস্তা নাহয় কমই তৈরি হল। হ্যাঁ, মোটে ৪ %!
    • কিংবা ধরুন PWD খাতে অর্থাৎ মূলত রাস্তা ঘাট সাড়াই করতে বরাদ্দ ৬৫০০ কোটি। নাহয় ১০ % রাস্তা এবছরটা নাই বাগালেন।
    • প্রসঙ্গত, মাদ্রাসা আর মাইনরিটি উন্নয়নেই বরাদ্দ ৪৫০০ কোটি। ওটা নিয়ে কিছু নাই বা বললাম।

এসব বাদ থাক। আরেকটা তথ্য শুনলে চোখ ছানাবড়া হবে। প্রথম ফেজের লকডাউনে পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি লস হয়েছে প্রায়  দেড় লাখ কোটি। মানে আমি আপনি সাধারণ মানুষ চাষ-বাস চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হয়েছি বলে আমাদের সবার পকেট মিলিয়ে দেড় লাখ কোটি খসেছে। তাও সরকার লকডাউন করতে এত পছন্দ করে! অথচ এই বিপুল ক্ষতির ০.৪ % দিয়েই শুধুমাত্র যাদের পজিটিভ কেস তাদেরকে নিখরচায় আইসোলেশনে রাখা যেত।

অতএব, টাকা পয়সার দিক থেকে ভাবলে খুব একটা জোরালো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যে এটা কেন সম্ভব নয়?

তবে কি সমস্যাটা লোক লস্কর নিয়ে?

৫০০ সেন্টারের জন্যে নার্স ধরা হয়েছে মোট ৫০০০।  রাতারাতি এত নার্স পাবে কোথায়?

পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম পঞ্চায়েত গুলোয় হেলথ সাব সেন্টারে ৩০ হাজারের কাছাকাছি  এ এন এম নার্স নিয়োজিত। সঙ্গে কয়েক লাখ আশা কর্মী। এরকম জরুরী পরিস্থিতিতে এই বিপুল সংখ্যক এ এন এম নার্স এবং আশা কর্মীদের মধ্যে থেকে সেফ হোমে কর্মী নিয়োগ করতে  খুব সমস্যার থাকার কথা না। প্রসঙ্গত কোভিড ভ্যাক্সিনেশানের কাজে এঁরাই নিয়োজিত।

পশ্চিমবঙ্গে মেডিক্যাল সীট ৪০০০। ৫.৫ বছরের কোর্স ধরলে প্রায় ২০ হাজার ছাত্র। তাদের মাত্র ৫% কে রোটেশনে আপতকালিন ভিত্তিতে সেফ হোমে দেখাশোনার দায়িত্বে দেওয়াই যায়।

প্রভূত বেকার সমস্যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে চুক্তি ভিত্তিতে ৫০০০ ওয়ার্ডবয় নিয়োগ করা এমন কিছু কঠিন কাজ না। নিদেনপক্ষে টেন্ডার ডেকে বিভিন্ন সংস্থাকে এই দায়িত্ব দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে সরকারকে লোক নিয়োগ আর স্থায়ী করার দায় নিতে হয় না।

এই সময়ে সরকারী কর্মীর সঠিক ইউটিলাইজেশান নিয়ে আমরা পরে ডিটেল আলোচনা করব। আপাতত সামারি হল, যদি করোনা মোকাবিলাকে সত্যিই জরুরী অবস্থা বলে সরকার মনে করত, তাহলে এই কর্মী মবিলাইজেশান খুব বড় কিছু কাজ হত না।

এখন প্রশ্ন জাগে,

তবে কি এই ফ্রি সেফ হোম আইডিয়ার অন্য সমস্যা আছে?

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, সেফ হোম একেবারে নতুন কোনও আইডিয়া না। সরকারই অলরেডি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে বেড সংখ্যা অপ্রতুল। এবং আরও একটা ব্যাপার, স্টেডিয়াম বা ফাঁকা বড় জায়গাকে সেফ হোম বানাতে ইনিশিয়াল খরচ বিপুল – স্ট্রাকচার বানানো, বিদ্যুৎ সরবরাহ, আলো-পাখার বন্দোবস্ত, টয়লেট, জল প্রভৃতি একরকম শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। আপতকালিন পরিস্থিতিতে কয়েকমাসের জন্যে বন্ধ স্কুল কলেজ ব্যবহার করা অনেক সস্তা হত। তো এতে করোনায় পুরো রাশ টানা না গেলেও হসপিটাল গুলোর ওপর চাপ বিপুল কমবে, এবং জন মানসে প্যানিক উবে যাবে, এ ব্যাপারটা নিশ্চিত। সঙ্গে হোম আইসোলেশানের সামাজিক সমস্যা গুলো থেকে রেহাই।

এরপরেও লকডাউন কেন তবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউন একদম শেষ সমাধান হওয়া উচিৎ। যখন কোনও ভাবেই কোনও কিছু হওয়া সম্ভব না, শুধু মাত্র তখনই লকডাউন আরোপের কথা ভাবা যায়। লকডাউনে যে লাখ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, প্রান্তিক মানুষের রুটি রোজগারের সমস্যা, সেটা বর্তমান কোভিড পরিস্থিতির থেকে অনেক ভয়াবহ। বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করা যাক। আপাতত প্রশ্ন করা যাক, তবু লকডাউন কেন?

আসলে সমস্যা টাকায় না, অন্য সমাধান গুলোয় যে বিপুল ম্যান ম্যানেজমেন্টের দরকার, তার ক্ষমতা বা সাহস গবেট মন্ত্রী মশাই দের নেই। তার জন্যে পরিকল্পনা লাগে, ভাবনা লাগে। কিন্তু লকডাউন ঘোষণা করতে একজন মুখ্যমন্ত্রীর সময় লাগে দু ঘণ্টা – একটা এক ঘণ্টার এক তরফা মিটিং, আর একটা প্রেস রিলিজ। তারপর আবার তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন এই ভেবে, আহা কিছু একটা তো করলুম! কে না জানে, ধুলো ওড়াতে ঝাড়ু  হলেই চলে।  কিন্তু জুতো তৈরিতে লাগে ক্রিয়েটিভ মাইন্ড।

সব চেয়ে বড় কথা, রাজনীতি। রাজ্যময় ধুলো উড়লে মনে হয় একটা কিছু হচ্ছে। মন্ত্রী সান্ত্রিরা কিছু একটা করছে। সাধারণ দু জোড়া জুতো তে সমস্যা সমাধান হয়তো হয়, সার্কাস টা কি হয়? আর সার্কাস না থাকলে ভোট দেবে কি লোকে এমনি এমনি?

Leave a Reply

Scroll to Top