মাঝে মাঝে মনে হয় ক্লাস এর ‘bad boy’ থেকেও কিছু জিনিস শেখা যেতেই পারে।
এই যেমন ধরুন উম্পুনের পরে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত কলকাতা শহরের ছবি গুলো। রাস্তা ব্লক করে গাছপালা পড়ে আছে। বিদ্যুৎ খুঁটি ভেঙে গেছে। জল নেই, বিদ্যুৎ নেই। এক্কেবারে যা তা অবস্থা। আর আমার আপনার মত সাধারণ মানুষের রিয়াকশন কেমন? একদিকে নবকুমারিচিত আহা!-কি-দেখিলাম-জন্ম-জন্মান্তরেরও-ভুলিব-না-এমন-ঝড় টাইপ অনুভূতি। আর অন্যদিকে এটা একটা সেঞ্চুরিতে-একবার-হয় মার্কা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তা জেনেও এ-বাবা-এখনও-কেন-কারেন্ট-এলো-না বলে জনগনের রে রে বিক্ষোভ।
না মশাই, আমি পপুলার ন্যারেটিভ নিয়ে আরেকবার একঘেয়ে গেঁজিয়ে লাইক কুড়বো বলে লিখি না কখনও। অতএব আমি বলব না, হে জনগন, সাগরদ্বীপে লোকজন খাবার, জল পাচ্ছে না। তোমরা এদিকে বিদ্যুৎ নিয়ে কান্না কাটি করছ? কারণ সাগরদ্বীপের জন্যে সহানুভূতি দেখিয়ে ঘরে চুপটি মেরে বসে থাকলেই সরকার বাহাদুর এরকম পলিসি নেবে না, যে হে কলকাতার কর্মী গন, এরকম পরিস্থিতিতে তোমরা বরং সুন্দরবনে ছুটে যাও। সেখানে মানুষের আরও হাহাকার অবস্থা।
তো সেটা যখন হবে না, অতএব যার যেখানে যা ডিউটি সেটা ঠিকঠাক পালন করছে কিনা সেটা বুঝে নেওয়াই সচেতন জনগনের কর্তব্য। আঁতেল গাল দেবার আগে বলে রাখি, না, এটা বললাম বলেই, কোনও সময় না দিয়েই (এবং বিশেষত করোনা পরিবেশে) মানুষ যে এত তাড়াতাড়ি অধৈর্য হয়ে পড়ছেন, সেটাকে সমর্থন করি না। একেবারেই না।
যাক গে। যে কথা বলতে এসেছিলাম। সঙ্গের এই ছবিটি একটা ডকুমেন্টারি থেকে নেওয়া স্ক্রীনশট। ডকুমেন্টারিটা কোথাকার? উত্তর কোরিয়ার – হুম, ক্লাসের বাজে ছেলে। তো সেখানে শীত কালে তুষার পড়ে রাস্তা ব্লক হলে কি হয়? জনগণই অফিস যাবার আগে নিজেরা বেলচা টেলচা নিয়ে তুষার সরিয়ে দেয়। এটাই তাদের ডিউটি। নইলে? নইলে কি হবে সে জানি না। বুঝতেই পারছেন দেশটার নাম উত্তর কোরিয়া। তবে ব্রেন ওয়াশ করে জনগনের এমন অবস্থা করেছে, এটা যে তাদের ডিউটি, তা তারা নাকি এমনিই বোঝে। আলাদা করে খুব একটা পুলিশ কাছারি করতে লাগে না।
ঠিক এখানেই আমার ভাবনাটা। আমাদের, মানে ভারতের জনগনের ব্রেনটা কেমন করে কাজ করে? আমরা ধরে নিই আমাদের ঘরের পাঁচিলের বাইরে বেরলেই বাকি কোথাও আমাদের ডিউটি নেই। সব করবে সরকার, মানে সরকারের লোক। এমনকি খুব বড় একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরেও আমরা ধরে নিই সরকারের দায়িত্ব ছিল আগে থেকে যথেষ্ট লোক রাখা যাতে এগুলো করা যায় তাড়াতাড়ি। আমরা ভুলে যাই, এত লোক রাখতে গেলে বাকি সময়টা বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দিতে হবে। মোদ্দা কথা, আমরা বিক্ষোভ করব, সংবাদ মাধ্যমের মাইকের সামনে হেব্বি রাগিরাগি বাইট দেবো। তবুও একটা গাছের একটা ডালও নিজেরা কেটে সরাবো না।
গ্রামের দিকে এতটা হয় না। ছোটবেলায় দেখতাম এরকম কিছু হলে পাড়ার সব লোক জড় হয়ে হাত লাগিয়ে সরিয়ে ফেলত। এখন কি হয় জানি না। প্রায় ৯ বছর হয়ে গেলো শহরে আছি – পড়াশুনো সুত্রে। ভয় হয়, তারাও বুঝি বড্ড ‘জনসচেতন’ হয়ে পড়েছে। কারণ আমাদের কাছে সচেতনতা মানে আমাদের রাইট আদায় করা, আমাদের ডিউটি পালন করা না। ‘ভরসা’ একটাই – গ্রামে আলো এত তাড়াতাড়ি পৌঁছায় না।
তো যেটা বলছিলাম। মাঝে মাঝে ক্লাসের বাজে ছেলেটার থেকেও কিছু জিনিস শেখাই যায়। কি বলেন?
সুত্রঃ
উত্তর কোরিয়া নিয়ে যে ডকুমেন্টারিটার কথা আমি বলছিলাম সেটা দেখতে হলে এখানে ক্লিক করুন।
Pingback: আরেকটা বৃষ্টির গল্প - ২৩ শে জুন, ১৭৫৭ - স্বগতোক্তি